
- January 25, 2025
- By Dr. Dipa Mitra
- 632
- Blogs
তাজমহল- রূপকথা না কি ইতিহাস!
তাজমহল-এক প্রেমকথা
শাহজাদা খুরমের বয়স তখন মাত্র উনিশ (মতান্তরে চোদ্দো বা পনেরো)। আগ্রার বাজারে( মতান্তরে দিল্লীর মীনাবাজারে) হঠাৎ দেখা পরমাসুন্দরী আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে। প্রথম দর্শনেই মন হারিয়ে বসেন শাহজাদা, চতুর্দশবর্ষীয়া (মতান্তরে ত্রয়োদশবর্ষীয়া) এই কন্যার অপরূপ রূপমাধুর্যে। এই ঘটনার পাঁচ বছর পর তাঁরা বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন। তবে রাজনৈতিক কারণে অবশ্য এই বিবাহের পূর্বেই পারস্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন খুরম, ভবিষ্যতের ভারত সম্রাট শাহবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহজাহান।
এই আরজুমান্দ বানুই পরবর্তীকালে শাহজাহানের সবচেয়ে প্রিয় বেগম মুমতাজ বা মমতাজ। তৎকালীন কবি বা ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী তাঁর সৌন্দর্যের ছটায় যেন লজ্জা পেত আকাশের চাঁদ। শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, সম্রাট তাঁর অন্তরের সৌন্দর্যেও ছিলেন মন্ত্রমুগ্ধ। তাই তো তিনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন তাঁর মমতাজকে। কিন্তু মাত্র উনিশটি বসন্ত একসাথে অতিবাহিত করার পরেই এমন মধুর দাম্পত্য জীবন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যু হয় মমতাজ বেগমের। জনশ্রুতি অনুযায়ী, পত্নীশোকে কাতর শাহজাহান আহারাদি বিসর্জন দিয়ে নিজেকে সাত দিন সাতরাত নিজকক্ষে ইচ্ছাবন্দী করে রাখেন। আরও শোনা যায়, সাত দিন পর তিনি যখন জনসমক্ষে আসেন, তখন তাঁর ধূসর কেশ, বিবর্ণ মুখ, ঠিক যেন এক জীবন্মৃত মানুষ; যাঁর শুধু দেহটুকুই আছে, প্রাণ যেন চলে গেছে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় মুমতাজের সাথেই। এই শোকবিহ্বল অবস্থায় তাঁর সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে তাঁর প্রিয়তমা পত্নীকে এ পৃথিবীর বুকে অমর করে রাখার জন্য তিনি এমন এক স্মৃতিসৌধ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, যা বিশ্বের দরবারে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করবে তাঁদের প্রেমকথার, সারা দুনিয়া কুর্ণিশ করবে এই মৃত্যুঞ্জয়ী ভালবাসার, অমর হয়ে থাকবেন মুমতাজ বেগম, তাঁর স্বপ্নের মুমতাজমহলে।
বিশ্বকবি এই অক্ষয় অবিনশ্বর অতুলনীয় সৃষ্টি প্রসঙ্গে লিখলেন- “এ কথা জানিতে তুমি , ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান , কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান । শুধু তব অন্তরবেদনা চিরন্তন হয়ে থাক্ সম্রাটের ছিল এ সাধনা । রাজশক্তি বজ্র সুকঠিন সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন , কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ এই তব মনে ছিল আশ । হীরা মুক্তামানিক্যের ঘটা যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক , শুধু থাক্ একবিন্দু নয়নের জল কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল। ”
শুরু হল সেই শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহলের নির্মাণকার্য ! ১৬৩২ সালে ৪২ একর জমিতে হাজার হাজার শ্রমিক দীর্ঘ ১১ বছরের অমানুষিক পরিশ্রমে যমুনা নদীর দক্ষিণ তীরে গড়ে তোলে ভিত্তি ও সমাধি, এরপর একে একে তৈরি হয় চারটি মিনার, মসজিদ ,জাওয়াব এবং প্রবেশ দরজা; তবে সে কাজ সম্পূর্ণ হতে লেগে যায় আরও ১০ টা বছর। আনুমানিক ভাবে, তাজমহলের উচ্চতা প্রায় ১৮০ ফুট এবং এর প্রধান গম্বুজ টির উচ্চতা ২১৩ ফুট , এটি চওড়া ৬০ ফুট। চারটি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট।সম্পূর্ণ কমপ্লেক্সটির আয়তন ১৯০২×১০০২ ফুট।শুধু তাজমহলটি ১৮৬ বর্গ ফুট যা সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরের উপর নির্মিত। সুদীর্ঘ ২১/২২ বছরে ২০০০০ শ্রমিকের নিরলস পরিশ্রমে (স্থানীয় মতে ১০০০০ দিনে ও ১০০০০ রাতে), অবশেষে ১৬৫৩ সালে চারদিকের ইমারত ও চারবাগ সহ সম্পূর্ণ হয় এই অন্যোন্যসুন্দর স্মৃতিসৌধ্য।
প্রযুক্তিহীন যুগেও কি অসামান্য প্রযুক্তিমনস্কতা ! তাজমহলের চারদিকের চারটি স্তম্ভ একটু হেলানো যাতে কোন কারনে এগুলি ভেঙ্গে পড়লেও তা যেন মূল সৌধের উপর পড়ে তাঁকে ক্ষতিগ্রস্থ না করতে পারে। স্হাপত্য শৈলীর এ এক অসাধারণ নিদর্শন।
তবে কোন বিশেষ একজন স্থপতিকারের তত্ত্বাবধানে নয়, এই অভূতপূর্ব শৈল্পিক সৌধের সাথে জড়িয়ে আছে সুদূর পারস্যের বহু প্রকৌশলী ও শিল্পীদের নাম।তবে এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ আছে প্রধান নকশাকার উস্তাদ আহমেদ লাহুরি (লাল কেল্লার স্থপতি), মীর আব্দুল করিম(সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয় স্থপতি) এবং মুক্কারিমাত খানের নাম। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ছিলেন ওস্তাদ ঈসা, আমানত খান, কাজিম খান, চিরঞ্জিলাল এবং মোহাম্মদ হানিফ। এদের দলবদ্ধ প্রচেষ্টায় মূলত পারস্য ও মুঘল স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে(রাজস্থান, পাঞ্জাব, পারস্য, আফগানিস্থান, চীন, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা সহ বিভিন্ন দেশ থেকে) বহুমূল্য মার্বেল পাথর সহ প্রায় ২৮ রকম অন্যান্য বহুমূল্য পাথর, রত্ন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী এনে গড়ে উঠেছিল শাহজাহানের সাধের মুমতাজমহল ; পাথরগুলির মধ্যে ছিল আফগানিস্তান থেকে ল্যাপিস লাজুলি, শ্রীলঙ্কা থেকে নীলকান্তমণি, ফিরোজা ছিল তিব্বত থেকে, জেড ও ক্রিস্টাল চীন থেকে, আরব থেকে কার্নেলিয়ান এবং পাঞ্জাব থেকে জ্যাসপার। সাদা মার্বেল রাজস্থানের মকরানা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। বিজ্ঞানের অসাধারণ ব্যবহারে এক অভাবনীয় স্থাপত্যশিল্পের সাহায্যে ( কোনও আধুনিক যন্ত্র ছাড়াই) গড়ে উঠেছে তাজমহল, যার যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে অপটিক ইলিউশনের মায়াজাল।
বর্তমানে পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের অন্যতম সেরা এই স্থাপত্যকীর্তি (২০০০-২০০৭ এর নতুন পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা অনুযায়ী) যদি মরমী মন নিয়ে ঘুরে দেখা যায়, তবে আজ এই একুশ শতকেও রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করা যায় এক বিরহী প্রেমিকের হাহাকার।
প্রেম ও বিরহের এমন অভাবনীয় যুগলবন্দী সারা পৃথিবীতে বিরল। এখানেই তাঁর প্রাণপ্রিয়া বেগমের সমাধির পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে রইলেন ভারত সম্রাট শাহজাহান। বয়ঃসন্ধিতে যে প্রেমের সূত্রপাত, যৌবনে যার উন্মত্ততা, শেষ শয়ানে তার পরিপূর্ণতা পেল চিরমিলনে, জীবনে মরণে একাকার হয়ে গেল দুই প্রেমিক হৃদয়- শাহজাহান ও মুমতাজ।
এই নয়নাভিরাম শ্বেতশুভ্র স্মৃতিসৌধ, প্রেমের মাহাত্ম্য তাই যুগে যুগে ছুঁয়ে যায় মানবমনের কোমলগ্রন্থিকে ! সেই ভাববিহ্বলতা, সেই প্রিয়াবিয়োগে ব্যথাতুর প্রেমিক হৃদয়ের হাহাকার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর অপরূপ ছন্দমাধুর্য্যে- “তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি এড়াইয়া কালের প্রহরী চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া ‘ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া’।” -কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সত্যি কি অনির্বচনীয় প্রেম! এই সমাধিসৌধের অপূর্ব সৌন্দর্য , কারুকার্য ও সর্বোপরি যুগান্তব্যাপী প্রেম বিমুগ্ধ করেছে দেশবিদেশের লক্ষকোটি পর্যটকদের। কাব্যে, নাট্যে, চলচ্চিত্রে, সঙ্গীতে তাজমহল আজও যেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ইঁট কাঠ পাথরের কৃত্তিম জগতে এমন ঐশ্বরিক প্রেমের জ্বলন্ত নিদর্শন দেখতে দেশ বিদেশ থেকে প্রতি বছর ছুটে আসে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ পর্যটক। বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর লেখনীতেও নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্মানবোধ ও সহাবস্থান প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন তাজমহলের নাম, যা আজও আমাদের রোমাঞ্চিত করে- তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ? অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান। -নারী, কাজী নজরুল ইসলাম
ইতিহাস – রূপকথা নয়
উপরোক্ত ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সবার জানা। কিন্তু এই অপার্থিব প্রেমকাহিনীকে আরও নিবিড় ভাবে আরও বিস্তারিতভাবে জানার সুতীব্র ইচ্ছা নিয়ে সেইসময়কার ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ, বা এই বিষয় নিয়ে যাবতীয় গবেষণা পর্যালোচনা করলে স্তম্ভিত হতে হয়। কোথায় প্রেমের তাজমহলের পূর্ণিমার চাঁদ! একটু সূক্ষ্মভাবে নিরপেক্ষ আতসকাঁচে বাস্তবের দলিল দস্তাবেজে চোখ রাখতেই ঝাপসা হয়ে এল আবেগ- দেখা গেল প্রকৃত অর্থেই পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি! সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুরজাহানের ভ্রাতুষ্পুত্রী পারস্যসুন্দরী মমতাজ ছিলেন শাহজাহানের তৃতীয়া (মতান্তরে দ্বিতীয়া) স্ত্রী। বংশ কৌলীন্য থাকলেও তিনি কোন রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নি। তিনি সেই সময়কার মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী নুরজাহানের পরমাত্মীয়া হলেও তাঁর প্রিয় পাত্রী কখনোই ছিলেন না। যবে থেকে সেই চতুর্দশবর্ষীয়া কিশোরীর সাথে শাহজাদার প্রথম দর্শনেই প্রেম, সেই দিন থেকেই আরজুমান্দ হয়েছিলেন প্রাসাদ রাজনীতির শিকার। আর হয়ত সেই কারণেই তাঁদের প্রেম ও বিবাহের মাঝখানে অতিবাহিত হয়ে যায় পাঁচ পাঁচটি বছর।এরই মধ্যে শাহজাহানের বিবাহ সম্পাদিত হয় পারস্যদেশের রাজকন্যার সাথে।
রাজনীতির পাশাখেলায় অভিজ্ঞ মুঘল সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিকারিণী সম্রাজ্ঞী নুরজাহান তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন এই অধিকার। তাই তিনি তাঁর প্রথমপক্ষের কন্যাসন্তানের সাথে শাহজাদা শাহরিয়রের বিবাহ দেন এবং শাহারিয়ারকে সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা করেন বিভিন্ন কূটনৈতিক চালে। ফলস্বরূপ শাহজাহানের ( তখন যিনি শাহজাদা খুরম) সাথে নুরজাহানের বৈরীতা শুরু হয়। আর স্বভাবতই শাহজাহানের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে জাহাঙ্গীরের।
শাহজাদা খুরম তখন রাজপ্রাসাদের দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে বেরিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মুক্ত বাতাস। ঠিক সেইসময় তাঁর সাথে দেখা সঙ্গীত ও নৃত্যপটীয়সী গুল-আরা-বেগমের। এই হিন্দু রমণীর ‘গুল-আরা’ নাম শাহজাহানেরই দেওয়া। তাঁর অপূর্ব সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় বিমুগ্ধ শাহজাহান শুধু যে তাঁর সাথে বিবাহ করেন তাই নয়, তাঁর প্রেমের স্মারক হিসেবে নির্মাণ করেন দুটি মহল, একটি কারারায় অপরটি বারহানপুরে।
‘বাদশাহনামা’য় আব্দুল হামিদ লাহোরি এই স্থানের সৌন্দর্য্য বর্ণনায় একে ‘তাজগি-এ-হায়াত’ এর উপমা দিয়েছেন, ‘শাহানামা’তে একে তুলনা করা হয়েছে ‘কাশ্মীরের’ সৌন্দর্যের সাথে, আর শাহজাহানের প্রিয় বিখ্যাত পার্সি কবি মুহিব আলি সিঙ্ঘি এই স্থানকে ‘স্বর্গ’ রূপে অভিহিত করেছেন।
গুল-আরার আকর্ষণে আর এই স্বপ্নমহলের টানে শাহজাহান বারেবারে ছুটে যেতেন বারহানপুরে। উতবলি নদীর উপর নির্মিত এই অনিন্দ্যসুন্দর স্থানে গুল-আরার সঙ্গীতের মূর্ছনায় চাঁদনী রাতের অনাবিল সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে থাকতেন শাহজাদা। কিন্তু গুল-আরা-বেগম সন্তানসম্ভবা হলে প্রমাদ গোনেন মুমতাজের পিতা আসফ খাঁ। তবে কি গুল-আরার সন্তান হয়ে উঠবে মুঘল সিংহাসনের দাবীদার? নিজ দৌহিত্রদের মঙ্গলসাধনে তাই তাঁর জামাতা শাহজাহান এই আনন্দ সংবাদ জানার আগেই তিনি সবার অজ্ঞাতে রাতের অন্ধকারে বারহানপুর এসে সুকৌশলে হত্যা করেন গুল-আরা-বেগম ও তাঁর অনাগত সন্তানকে। নদীর জলে বিলীন হয়ে যায় তাঁর নশ্বর দেহ, শুধু থেকে যায় বারহানপুরের সেই গুল-আরা-মহল, তাঁর ও শাহজাহানের অবিনশ্বর প্রেমের সাক্ষী হয়ে। কে বলতে পারে তিনি বেঁচে থাকলে তাজমহল সৃষ্টি হত কিনা!
কারণ মমতাজ বেগমের জীবিতাবস্থায় তাঁকে নিয়ে শাহজাহানের প্রেমের উন্মাদনায় সেইসময় তাঁর জন্য এহেন কোন বিশেষ মহল নির্মাণের কোন কথা কিন্তু ইতিহাসে লেখা নেই। তৎকালীন রাজা বা নবাবদের ক্ষেত্রে যা ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। ভাবতে অবাক লাগে এত গভীর প্রেমের কথা, যা নিয়ে সারা বিশ্বে এত আলোড়ন, তৎকালীন কোন সরকারি নথিপত্রে বা গ্রন্থে কেন তার কোনও উল্লেখ নেই!
বরং এই নিয়ে যাবতীয় গবেষণা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় শাহজাহান অত্যন্ত শিক্ষিত, যুদ্ধনিপুন ও শিল্পীমনস্ক হলেও যথেষ্ট রাজনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন নবাব ছিলেন, যিনি সিংহাসন লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় হত্যা করেছিলেন তাঁর আপন সহোদরকে।
মমতাজকে তিনি যদি এতই ভালবাসতেন তাহলে তাঁকে বিবাহের পর আর কোনও নারীতে তিনি আসক্ত হতেন না। গুল-আরা- বেগম আসতেন না তাঁর জীবনে। আর শুধু তিনি কেন, শাহজাহান একাধিক বিবাহ করেন। এমনকি শোনা যায় তাঁর ‘প্রানাধিক প্রিয়’ স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি মমতাজেরই ছোট বোনকে বিবাহ করেন।
আবার এহেন প্রেমিক পুরুষ কিন্তু তাঁরই জ্যেষ্ঠা কন্যা জাহানারার প্রেমের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মমতাজ কন্যা জাহানারা, যে শেষ জীবনের বন্দীদশায় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল; কথিত আছে তিনি নাকি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন কন্যার প্রেমিককে। আর যে মমতাজের জন্য এত ‘হাহাকার’, সেই প্রিয় পত্নীর এহেন অকালমৃত্যুর জন্য সম্রাট তো নিজেই বহুলাংশে দায়ী। না, মুঘল সম্রাটকে দোষারোপ করার জন্য এ কোনও মনগড়া গল্প নয়, এর ভিত্তি ঐতিহাসিক তথ্যসম্বলিত।
মুঘল ইতিহাসের প্রামান্য নথি অনুযায়ী বিবাহের ১৯তম বছরে ১৪ টি সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছিল মমতাজকে! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তাঁর জীবিত সন্তানদের নাম যথাক্রমে জাহানারা, দারাসিকো, শাহ সুজা, রওশানারা, আওরঙ্গজেব, মুরাদ ও গওহর বেগম। এছাড়াও অবশ্য শাহজাহানের ঔরসজাত আরও ১০ টি সন্তান ছিল। তখনকার দিনে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে সন্তান প্রসবকালে সন্তান বা মায়ের অথবা দুজনেরই মৃত্যু ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। হয়ত বা এইজন্যেই তাঁর ৭ টি সন্তান অকালেই মৃত্যুবরণ করেছিল। আর এইভাবেই ১৪ তম সন্তান প্রসব করতে গিয়ে অর্থাৎ গওহর বেগমের জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের ফলে মাত্র ৩৮ বছর বয়েসে মমতাজ মারা যান আগ্রা থেকে ৬০০ মাইল দূরে, বারহানপুরে (বর্তমান মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত) ।সেখানেই তিনি সমাধিস্থ হন। শাহজাহান এতোই যদি ভালবাসতেন তাঁর মমতাজ বেগমকে, তবে কেন ভালবাসার নামে বারেবারে তাঁকে ঠেলে দিতেন এমন অবশ্যাম্ভাবী মৃত্যুর দিকে? অস্বীকার করার উপায় নেই যে শাহজাহানের একপ্রকার নির্বুদ্ধিতার ও হঠকারিতার ফলস্বরূপ মৃত্যু হয় মমতাজের। গর্ভবতী অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেন সম্রাট। দুর্গম রাস্তা দিয়ে হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতেই তাঁর সময়ের পূর্বেই প্রসববেদনা ওঠে, সুদীর্ঘ ৩০ ঘণ্টা সেই যন্ত্রণা সহ্য করে, শেষপর্যন্ত সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন মুঘল সম্রাজ্ঞী। একবারও কি তখন তাঁর মনে হয়নি, তাঁর প্রিয়ার শারীরিক সুস্থতা তাঁর কাছে অনেক বেশি কাঙ্খিত হওয়া উচিত ছিল? ভালবাসার নামে এহেন অত্যাচারের পর তার স্মরণে এমন হাজারটা তাজমহল বানালেও এ অন্যায়ের ক্ষমা হয়না। এ শুধু তাঁর নিজস্ব অভিলাষসিদ্ধি, ক্ষমতাপ্রদর্শন ও নিজ মুকুটে আরও এক অন্যোন্য স্থাপত্য কীর্তির পালক প্রস্থাপন মাত্র! নইলে খুব কি প্রয়োজন ছিল সমগ্র বিশ্বের কাছে নিজের ভালোবাসা জাহির করতে চিরনিদ্রায় শায়িত মমতাজবেগমকে তাঁর শেষ শয়ানের স্থান থেকে তুলে এই সুদূর আগ্রায় বহন করে এনে প্রজাদের রক্তজল করা টাকায় ভরা রাজকোষ উজাড় ক’রে এমন ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণ করার? কোটি কোটি অর্থ (তৎকালীন আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন রুপি যা বর্তমান ২৮,৩১৪ কোটি টাকার সমান) ব্যয় করে ২২ বছর (মতান্তরে ২১ বছর) ধরে নাকি চলে এই নির্মাণকার্য! গড়ে ওঠে এক নয়নাভিরাম পৃথিবীবিখ্যাত স্থাপত্যকীর্তি। আশ্চর্য জনক ভাবে এই নির্মাণকার্যের সময়সীমা বা খরচের হিসাব কোন কিছুরই কিন্তু তেমন কোন প্রামান্যনথি পাওয়া যায় না। আর বিস্ময়করভাবে শাহাজাহানের সমকালীন প্রায় সমস্ত ঐতিহাসিক গ্রন্থে অনালোচিত থেকে যায় শাহজাহান মমতাজের এই দুর্নিবার প্রেমকাহিনী। কৌতূহলী মন খুঁজে বেড়ায় ইনায়েত নামা, জামিউল ইনশা, জামিউল মারাশিলি–ইত- জি উলালবাব, বাহার -ই -সুখা ও চার চমন থেকে সুবিখ্যাত শাহজাহান-নামা ও পাদশাহনামা। কই, কোথাও তো হদিশ মেলে না, এই অপ্রতিরোধ্য মুঘল প্রেমকথার! তবে কি সবটাই জনশ্রুতি? তবে কেন নির্মিত হল তাজমহল? এত অর্থব্যয়, এতজনের মিলিত শ্রম, সবটাই কি তবে ভিত্তিহীন?
তাজমহল নাকি শিবমন্দির!
তাজমহল নিয়ে বিতর্ক বা গবেষণা আজ নতুন নয়। বহু শতক ধরে বহু প্রশ্ন জমে আছে এই স্মৃতিসৌধকে কেন্দ্র করে। কয়েক দশক আগেও তাজমহল নিয়ে বহু বিতর্ক ঘনীভূত হয়েছে। এমনকি শান্তি বজায় রাখার জন্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজমহল নিয়ে লেখা এক লেখকের বই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ ওই বই প্রকাশ হলে তাজ মহল নিয়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা ছিল। আসলে অবিভক্ত ভারতবর্ষের ইতিহাস, ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত এই উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উল্লেখিত হয়েছে। তাই একই ঘটনা ভারত পাকিস্থান বা বাংলাদেশে ভিন্ন ব্যাখ্যা পায়। যেমন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে যে মুঘল ইতিহাস পড়ানো হয় তা কিন্তু ভারতবর্ষের স্কুলপাঠ্যের চেয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকম। ভারতের অত্যাচারী মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কিন্তু বাংলাদেশে নায়কোচিত সম্মান পান; আবার ভারতের গর্ব বিশ্ববন্দিত তাজমহল সেখানে তেমনভাবে স্বীকৃতি পায় না। ঠিক এভাবেই ভারতবর্ষেও তাজমহল নিয়েও দুরকম মতবাদ আছে। এদেশের জনগণের সিংহভাগ যেমন বিশ্বাস করে এটি সম্রাট শাহজাহান তৈরি, তেমনি আবার কিছু হিন্দুবাদী মানুষের মতে তাজমহল আসলে একটি শিবমন্দির।
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তথ্য অধিকর্তা শ্রীধর আচার্য জানান যে অনেকেই দাবি তুলেছেন, বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম এই নিদর্শনটি শিবমন্দির হিসেবে মোগল সম্রাজ্যকে উপহার দিয়েছিলেন এক রাজপুত রাজা। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী তাজমহলের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মামলা নানা সময়ে ভারতের সুপ্রিমকোর্টসহ সমস্ত উচ্চ আদালতে খারিজ করে দেওয়া হয়, যার মধ্যে ছিল ইতিহাসবিদ পি এন ওক ও আইনজীবী যোগেশ সাক্সেনার তাজমহলকে শিবের মন্দির হিসেবে দাবি করার একটি মামলাও; তবে তিনি আরও জানান এ সংক্রান্ত আরও কয়েকটি মামলা এখনো আদালতে অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সেই বই ‘দ্য তাজ মহল ইজ তেজো মহালয়া’ (রচনাকাল ১৯৭০-৮০ সাল) এর লেখক পুরুষোত্তম নাগেশ ওক পেশায় একজন সাংবাদিক ও আজাদ হিন্দু রেডিও বক্তা ছিলেন, যিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে জাপানীদের সঙ্গে ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধ করেন, ও পরবর্তীকালে ভারতের তথ্যমন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবেও বহুদিন কাজ করেন।
পুরুষোত্তম নাগেশ ওক তাঁর ‘তাজমহল দ্য ট্রু স্টোরি’ ও ‘দ্য তাজ মহল ইজ তেজো মহালয়া’ এই বই দুটিতে দাবি করেন তাজমহল শাহজাহান দ্বারা নির্মিত নয়, এটি আসলে ভগবান শিবের মন্দির। সেখানে আগ্রার রাজপুত্ররা পূজার্চনা করতেন। তিনি ইতিহাসের বহু তথ্য অনুসন্ধান করে দেখতে পান যে, সম্রাট শাহজাহান অন্যায়ভাবে জয়পুরের মহারাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে মন্দিরটি দখল করেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত স্ত্রীর স্মরণে স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলেন। তাঁর এই বক্তব্যের পিছনে তিনি যথেষ্ট যুক্তি দিয়েছেন, যা পর্যালোচনা করলে চিন্তার অবকাশ থাকে বৈকি। সম্রাট শাহজাহান তাঁর দিনপঞ্জি ‘বাদশাহনামা’তে উল্লেখ করে গেছেন, রাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে আগ্রার এক চমৎকার প্রাসাদোপম ভবন মমতাজ মহলের সমাধিস্থলের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে এবং এর জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে রাজা জয় সিংকে অন্যত্র জমিও কিনে দেয়া হয়েছে। নিউইয়র্কের আর্কিওলজিস্ট মারভিন মিলার তাজমহলের দেয়ালের নমুনা পরীক্ষা করে বলেন, তাতে যে কার্বন আছে তা সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলেরও ৩০০ বছরের পুরনো। আবার যে সময় তাজমহলের নির্মাণ নিয়ে উত্তাল থাকার কথা সমগ্র দিল্লী আগ্রার, সেইসময়কার এক ইউরোপিয়ান পর্যটক, যিনি ১৬৩৮ সালে আগ্রা ভ্রমণ করেন, বিস্ময়জনকভাবে তাঁর গ্রন্থে এমন এক চাঞ্চল্যকর নির্মাণকার্যের কথা কোথাও উল্লেখ করেননি! ভাবতে অবাক লাগে, কী করে সমসাময়িক গ্রন্থে অনুচ্চারিত থাকে তাজমহলের নাম!
এবার আসা যাক তাজমহল নাম প্রসঙ্গে- পুরুষোত্তমবাবুর মতে, তাজমহলের ‘তাজ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘তেজ’ থেকে আর ‘মহল’ এসেছে ‘মহালয়া’ থেকে। তাঁর বর্ণনানুযায়ী তাজমহলের আদি নাম ছিল ‘তেজো মহালয়া’।
আবার দিল্লির স্থানীয় মুসলিমরা বলেন ‘মমতাজমহলের’ নাম থেকে ‘মম’ বাদ দিয়ে তাজমহল রাখা হয়। কিন্তু ইসলামে ধর্মানুযায়ী তো নাম বিকৃত করা পাপ! মুঘল নথিপত্র থেকে জানা যায় মমতাজের পুরো নাম ‘আরজুমান্দ বানু বেগম’, আবার সরকারিভাবে প্রকাশিত শাহজাহান রচিত বাদশাহনামা অনুযায়ী তাঁর নাম ‘মমতাজ-উল-জামানি’; ‘মমতাজমহল’ নাম কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না। আবার লক্ষণীয় বিষয় হল ‘মমতাজ’ বানানটা শেষ হয় ইংরেজি বর্ণ ‘জেড’ দিয়ে, অন্যদিকে ‘তাজ’ বানানের শেষে রয়েছে ইংরেজি ‘জে’ বর্ণ। বানান পার্থক্য তো সত্যিই মনে প্রশ্ন জাগায়, আর এখানেই ভাবায় পুরুষোত্তম বাবুর যুক্তি।
আবার ফিরে আসি মন্দিরের প্রসঙ্গে- এই বিতর্কের পিছনে আরও যুক্তি আছে। কারণ সাধারণত মুসলিম নির্মিত গম্বুজে চাঁদ কিংবা তারা দেখা যায়। কিন্তু তাজ মহলের মাথায় যে গম্বুজটি রয়েছে তার শীর্ষে কোনও চাঁদ বা তারা নয়, দেখা মেলে ত্রিশূলের, যা ভগবান শিবের অস্ত্র। কিন্তু তাজমহলের মাথায় চাঁদ তারার বদলে ত্রিশূল! আবার মন্দিরের মতই তাজ মহলের দেয়ালে ‘ওম’ চিহ্নিত নকশা। কোনো মুসলিম মসজিদে বা সমাধিতে এই ধরণের নকশা কিন্তু বিরল।
বিস্ময়ের সূত্রপাত এখান থেকেই। তথ্যানুযায়ী এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহুমূল্য মার্বেল পাথর সহ অন্যান্য বহুমূল্য পাথর, রত্ন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী আনা হলেও শাহজাহানের মুমতাজমহলের মূল নকশাবিদরা বেশিরভাগই ছিলেন পারস্যের (বর্তমান ইরানের) নামকরা শিল্পী। তাই আশ্চর্য লাগে, ‘ওম’ চিহ্ন বা শিবের ত্রিশূল এর নকশা তো তাদের জানার কথা নয় আর জানলেও তা কিন্তু কখনোই মুসলিম সমাধিসৌধে প্রয়োগ করার কথা নয়।
তবে বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়, প্রশ্ন জাগে সমাধিস্থল তাজমহলে শতাধিক কক্ষ কেন নির্মাণ করলেন সম্রাট শাহজাহান? আর যদি নির্মাণই করলেন, তবে তাদের দ্বার কেন তিনি রুদ্ধ করে রাখলেন? তবে কি সত্যি এগুলি সেই বিতর্কিত মন্দির কক্ষ! এই প্রশ্নের কিন্তু আজও কোনও সদুত্তর মেলে না।
তবে তাজমহল যে শাহজাহানের সময়কাল থেকেও পুরানো সেরকম আভাস আমরা পাই শাহজাহান ও আওরাঙ্গজেবের পত্রালাপ সম্বলিত মোহম্মদ শালিহ কাম্বু রচিত ‘বাহার ই সুখান’ এ, যেখানে পিতাপুত্রের পত্রালাপ আমাদের সেই সময়কার ঘটনাবলী সম্পর্কে সমৃদ্ধ করে। ১৬৫২ সালে লেখা একটি চিঠিতে আওরাঙ্গজেব তাজমহলের সংস্কার করার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেছেন তাঁর পিতা শাহজাহানকে, জানিয়েছেন স্মৃতিসৌধের গম্বুজ ফেটে জল পড়ছে তাঁর মায়ের সমাধিতে। আবার আসে প্রশ্নচিহ্ন, ১৬৫৩ সালে সম্পূর্ণ হয় তাজমহলের নির্মাণ কার্য, তবে নবনির্মিত স্তম্ভে কি করে ফাটল ধরবে? তাহলে কি সত্যিই তাজমহল আসলে ৩০০ বছরের পুরোনো শিবমন্দির?
উপসংহার-
তাজমহল নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠলেও শাহজাহানের শিল্পীমন বা স্থাপত্য কীর্তি নিয়ে কারোও মনে সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। তাই তাজমহল ছাড়াও তাঁর রাজধানী শাহজানাবাদ, দিল্লীর লালকেল্লা ও জামা মসজিদ, লাহোরের মোতি মসজিদ ও শালিমার বাগ, আগ্রা ও লাহোর ফোর্টের কিছু অংশ, জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন এই মুঘল সম্রাট।
এবার আসা যাক মুমতাজ বেগমের প্রতি তাঁর প্রেমের তুল্যমূল্য বিচারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তাঁর ঠাকুরদা, শ্রেষ্ঠ মুঘলসম্রাট আকবরের পত্নী ও উপপত্নীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ৩০০, সেখানে তৎকালীন মুসলিমসমাজ তথা মুঘলসাম্রাজ্যের প্রবাহমান ধারার নিরিখে, শাহজাহানের নারীসঙ্গের পরিসংখ্যান তো নিতান্ত নগণ্য।
তাই সেই বিচারে সময়ব্যয় না করে, শাহজাহান ও তাঁর তাজমহলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তাঁর শৈশবজীবন, তবে জানতে পারবো তাঁর এই আপাত মধুর চরিত্র, অথচ বজ্রকঠিন সংকল্প, আবার ক্ষণভঙ্গুর হৃদয়ের নেপথ্য ইতিহাস। সূক্ষ্ম মননশীলতায় অনুভব করতে পারব এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ যোদ্ধা ও বিদ্বান সম্রাটের কেন এই দুঃখবিলাস, নিরাপত্তাহীনতা! স্বজনহত্যার রক্তে কলুষিত যাঁর হাত, সেই তিনিই আবার কেন বারেবারে আঁকড়ে ধরতেন তাঁর কাছের মানুষদের!
শুরু করা যাক সেই পর্যালোচনা- সম্রাট আকবর ও তাঁর প্রথম পত্নী রুকুয়া বেগম দত্তক নিয়েছিলেন ৬ দিনের শাহজাদা খুরমকে, পুত্রস্নেহে মানুষ করেছিলেন তাঁদের আদরের পৌত্রকে। কিন্তু খুরম, তিনি তো তাঁর পঞ্চাশোর্ধ্ব দাদু ঠাকুমার কাছে থেকেও প্রতি নিয়ত খুঁজে এসেছিলেন তাঁর বাবার আদর, মায়ের স্নেহাঞ্চল! বঞ্চিত হয়েছিলেন অন্যান্য ভাইদের মত বাবার সাথে খেলা, মায়ের কাছে ঘুমের অধিকার থেকে, আর কষ্ট পেয়েছিলেন মনে মনে। তাই মুঘল সম্রাটের নয়ন মণি হয়েও বারে বারে নিজেকে বঞ্চিত, অবহেলিত ভেবে এক অদ্ভুত অভিমান ও আত্মশ্লাঘার মাঝে দিন কাটিয়েছিলেন শাহজাদা। আর এই দোটানার মাঝেই হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজের নিরাপত্তাবোধ ও মানুষের প্রতি বিশ্বাস। আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর পুত্রকে কাছে টেনে তাঁদের সম্পর্কের ক্ষতে পিতৃস্নেহের প্রলেপ দিয়ে কিছুটা উষ্ণতা ফিরিয়ে আনতে না আনতেই, মূর্তমান শনির মত বিমাতা নুরজাহান অবতীর্ণ হলেন খুরমের জীবনে। শাহজাদা আবার হারিয়ে ফেলেন তাঁর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। তাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অমোঘ নেশায় তিনি প্রাধান্য বিস্তার করেন দাক্ষিনাত্যে, সমস্ত বিদ্রোহ দমন করে নিজেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। আসলে সেই ছোট্টবেলা থেকে দাদু আকবর তাঁকেই মুঘল সম্রাটের উত্তরসুরী হিসেবে গড়ে তোলেন। পিতা জাহাঙ্গীরের যুদ্ধ জয়ের নায়ক শাহজাদা খুরম তাই তৃতীয় সন্তান হয়েও ছিলেন সিংহাসনের যোগ্যতম উত্তরাধীকারি, আর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তিনি হত্যা করেন তাঁর আপন সহোদরদের তথা তাঁদের পরিবারের সমস্ত পুরুষ সদস্যদের আর প্রায় নজরবন্দী করেন নুরজাহান বেগমকে। এভাবে স্বজনবিনাশের মূল্যে পাওয়া রাজত্বে কি সুখ তিনি পেয়েছিলেন, তা আজ জানা দুঃসাধ্য।
তবে সারাটা জীবন তাঁর এইভাবেই কেটেছে পাওয়া না পাওয়ার ছন্দপতনে। কিন্তু বরাবর হারানোর দুঃখ তাঁর কাছে এতোটাই বড় হয়ে উঠেছিল তিনি পাওয়ার আনন্দ কখনোই উপভোগ করতে পারেন নি। আবার সেই পাওয়াটুকু শেষ হতেই, তা হারানোর ব্যথায় উন্মাদ হয়ে উঠত শাহজাহানের মন। হয়তো তাই- দাদু ঠাকুমার অনাবিল স্নেহচ্ছায়ায় সিঞ্চিত হয়েও তাঁর হৃদয় হাহাকার করে উঠত, বাবা মায়ের কাছে বড় হতে না পারার দুঃখ তাকে ক্ষতবিক্ষত করতো। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই পিতৃস্নেহের কাঙাল শাহজাদাই আবার অস্ত্র ধরেন পিতার বিরুদ্ধে। কি অদ্ভুত এই পরস্পরবিরোধী আচরণ!
আবার প্রিয়পত্নী মুমতাজ জীবিত থাকতে শুধুমাত্র তাঁকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে না তাঁর অশান্ত মন, তাঁকে ছুটতে হয় বারহানপুরে গুল-আরা-বেগমের কাছে, তাঁর সুরের মূর্ছনায় শান্তি খুঁজতে। আবার সেই স্ত্রী লোকান্তরিত হলেই তিনি যেন হারিয়ে ফেলেন তাঁর জীবনীশক্তি। পৃথিবীর বুকে মুমতাজের নাম অমর করে রাখতে তিনি গড়ে তোলেন জগদ্বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ। সাধারণ বুদ্ধিতে এর ব্যাখ্যা মেলেনা, বরং সম্রাটের অন্তরের সূক্ষ্মগ্রন্থির অন্তর্জালে জড়িয়ে জন্ম নেয় সহানুভূতি ও সহমর্মীতা।
তাই আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বপ্নের মুমতাজমহল কোনও শিবমন্দিরের অধিগ্রহণে নির্মিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করে যদি সময়যন্ত্রে পিছিয়ে যাওয়া যায় আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগের সেই মুঘল সাম্রাজ্যে, আমরা হয়তো মানসচক্ষে দেখতে পাব দিল্লীর মসনদের ‘ময়ূর সিংহাসনে’ আসীন সম্রাট শাহজাহান, আর অন্তঃপুরে তাঁরই জন্য প্রতীক্ষারত তাঁর জীবনের ‘কোহিনুর’, মুমতাজ বেগম। তাঁদের ১৯ টি বসন্তের ‘আটপৌরে’ প্রেম নাই বা রইল নথিভুক্ত হয়ে, তাজমহলের প্রতিটি দেওয়ালে কি গ্রথিত নেই তাঁদের অপূর্ণ প্রেমের দীর্ঘশ্বাস?
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় তাজমহল আসলে তেজো মহালয়া! তাতে কিই বা এসে যায়! কালের করাল গ্রাসে, বহির্শত্রুর আক্রমণে আমাদের দেশের কতো মন্দিরই তো ধ্বংস হয়েছে। তাতে কি নষ্ট হয়েছে দেবত্ব, ধ্বংস হয়েছেন ইশ্বর? হিন্দু মুসলিমের এ ভেদাভেদ তো মনুষ্যসৃষ্ট।
পুরাণমতে সতীর অকালপ্রয়াণে উন্মত্ত শিব প্রলয়নাচনে লণ্ডভণ্ড করেছিলেন বিশ্বচরাচর। তাই পত্নীবিয়োগের যন্ত্রণা তো নটরাজের অজানা নয়। তাই তাঁরই আঙিনায় যদি এক বিরহী স্বামী গড়ে তোলেন তাঁর প্রিয়ার স্মৃতিসৌধ, মৌলবাদীরা এই নিয়ে যতোই তরজা করুক, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মতে, এতে বোধহয় কোনও পাপ হয় না।
তাই মামলা চলুক তার নিজস্ব গতিতে, গবেষণা চলুক তার নিজস্ব ছন্দে, ঈশ্বরের ক্রোড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত থাক দুই প্রেমিক হৃদয়। আর তাজমহল তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে, মহিমা নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকুক তার আপন অহঙ্কারে আর যুগে যুগে মহিমান্বিত হোক ঐশ্বরিক পরিমণ্ডলের এই মহাজাগতিক প্রেম।
Dr. Dipa Mitra
Associate Professor & Former Head, M.Phil & Ph.D Program Indian Institute of Social Welfare & Business Management KOLKATA
RELATED BLOGS

A Handbook Of Retail Management: Principles & Practices
Retailing is the final step of an economic activity and the essence of retailing comprises of selling goods and.
- January 25, 2025
- By Dr.

New Year in perspective!
ইংরাজি নববর্ষের সুচনা- নববর্ষ! নামটা শুনলেই মনের আকাশে পুঞ্জিভূত দুঃখ ও হতাশার মেঘ কেটে গিয়ে আশা, আনন্দ ও স্বপ্নপুরনের.
- January 25, 2025
- By Dr.